আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির অপরিহার্যতা: একটি বিশ্লেষণ
নিজস্ব প্রতিবেদক, আলোধারা | ঢাকা
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে টিকে থাকার জন্য গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখন আর যথেষ্ট নয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর পথে যাত্রায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্য প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। নতুন কারিকুলাম ও আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রেক্ষাপট ও বর্তমান বাস্তবতা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে মুখস্তবিদ্যার যে প্রচলন ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রযুক্তি। সরকার ইতিমধ্যেই দেশের হাজার হাজার বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন এবং মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করেছে। তবে শুধুমাত্র ল্যাব স্থাপনই শেষ কথা নয়, এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই এখন মূল লক্ষ্য।
প্রযুক্তি নির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা
১. বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জন: বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থানের বাজার প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), কোডিং এবং রোবোটিক্সের মতো বিষয়গুলো এখন শিক্ষার অংশ। প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের এসবের সাথে পরিচয় করিয়ে না দিলে তারা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
২. জটিল বিষয় সহজীকরণ: বিজ্ঞান বা গণিতের মতো জটিল বিষয়গুলো শুধুমাত্র ব্ল্যাকবোর্ড ও চকের মাধ্যমে বোঝানো কঠিন। অ্যানিমেশন, ভিডিও এবং ডিজিটাল সিমুলেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে এই বিষয়গুলো জীবন্ত করে তোলা যায়, যা তাদের মনে গেঁথে থাকে।
৩. নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন: বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রম ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন’-এর ওপর জোর দিয়েছে। এই শিখন পদ্ধতিতে তথ্য অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনার জন্য ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রযুক্তির গুরুত্ব
শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণ: প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো এটি স্থান ও কালের সীমানা দূর করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামের একজন শিক্ষার্থীও শহরের নামিদামি স্কুলের বা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের লেকচার শুনতে পারে। এটি শিক্ষার গুণগত মানের সমতা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি: প্রযুক্তি শিক্ষকদের গতানুগতিক লেকচারার থেকে ‘ফ্যাসিলিটেটর’ বা সহায়তাকারীতে রূপান্তর করে। অনলাইন কুইজ, গেম-ভিত্তিক লার্নিং এবং ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্লাসরুমকে একঘেয়েমি থেকে রক্ষা করে এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
স্বকীয় শিখন (Personalized Learning): প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার গতি ভিন্ন। প্রযুক্তির সহায়তায় এডাপ্টিভ লার্নিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের গতিতে শিখতে পারে, যা প্রথাগত ক্লাসরুমে সবসময় সম্ভব হয় না।
চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়
প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের অভাব এখনো অনেক বিদ্যালয়ে প্রকট। তাছাড়া, প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার বা আসক্তি রোধে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতনতাও জরুরি।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়:
আগামীর স্মার্ট নাগরিক তৈরি করতে হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেই প্রযুক্তির বীজ বপন করতে হবে। প্রযুক্তি শিক্ষার কোনো বিকল্প নয়, বরং এটি শিক্ষার মান উন্নয়নের একটি শক্তিশালী বাহন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ এবং সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষাঙ্গনে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেই বাংলাদেশ একটি জ্ঞানভিত্তিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।