• শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:১১ অপরাহ্ন
  • [gtranslate]
Headline
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আধুনিক শিক্ষকতার গুণাবলী: একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন ধূমপানমুক্ত সমাজ গঠনে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ: গোলশূন্য খেলায় দু’দলই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ-২০২৬ দেশী ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ আপডেট: বিশ্লেষণ ও নির্দেশিকা (২০২৫-২৬) আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির অপরিহার্যতা: একটি বিশ্লেষণ রংপুরে ৫৬ দিনব্যাপী শিক্ষকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু ২০ ডিসেম্বর: বাংলা ও গণিত শিক্ষকদের অগ্রাধিকার হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন বিশ্লেষণ প্রাচীন সমতটের জনপদ থেকে আধুনিক কুমিল্লা: একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ নীল সীমার শেষ আলো এই দুনিয়ায় আমি এসেছি একা
Notice
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে একদুয়ারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মনোহরদী, নরসিংদী তে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি চলছে।           ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুরে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি চলছে।

নদী, মাটি ও মানুষের শব্দলোকে বাংলাদেশ

Reporter Name / ১২ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫
Mohammad Shahzaman Shuvoh

মোহাম্মদ শাহজামান শুভ।

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যখন আমরা কথা বলি, তখন আসলে আমরা একটি জীবন্ত, বহুমাত্রিক জগতের কথা বলছি—যা নদীর কল-কোল, ধানের পাতার শব্দ, বায়ুর হালকা স্পর্শ, মানুষের কাজের ঘামের গন্ধ, উৎসবের আলো-শব্দ, আর গভীর ইতিহাসের সঞ্চিত স্মৃতির সংমিশ্রণে গঠিত। এই জগতটি কেবল এক ধরনের কলা বা রীতিই নয়; এটি এক গভীর অভিজ্ঞতা, যা প্রতিনিয়ত নিজেকে উত্পাদন ও পুনর্গঠন করছে। সাহিত্যের মাধ্যমে এই অভিজ্ঞতা শব্দে, বাক্যে ও গঠনে রূপ নেয়; সংস্কৃতি তাৎপর্য ও রীতিনীতিতে পরিণত হয়। এই দুইয়ের সংযোগেই বাংলাদেশের আত্মপরিচয় তৈরি হয়েছে—একটি পরিচয় যা সময়ের স্রোতে বয়ে গেছে, কখনও বর্ধিত হয়েছে, কখনও ক্ষয়ক্ষতি পেয়েছে, কিন্তু কখনোই তার প্রাণ হারায়নি।

বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সাহিত্যের জন্য এমন এক অনবদ্য উৎস, যা লেখককে নিরন্তর ভাবনা দেয়। নদী এখানে শুধু স্থানগত অবকাঠামো নয়; এটি মানুষের মনে একটি প্রতীক, একটি চরিত্র, এক অভিজ্ঞতা। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার স্রোত, হাজারো খাল-নদীর জটিলতা এবং বর্ষার তীব্রতা—এসবই মানুষের জীবনকে গড়ে তোলে ও সাহিত্যে প্রবাহিত করে। নদী মানুষের জীবনকে সংযুক্ত করে, ভেদ করে, জীবনের রকমফেরকে আয়নায় তুলে ধরে। বন্যা ও জোয়ার-ভাটা গ্রামের মানুষের প্রতিদিনের গল্প, আর সেসব গল্পই সাহিত্যকে শক্তি দেয়। বর্ষার প্রথম বৃষ্টির গন্ধ, ধানক্ষেতে ছুটে বেড়ানো শিশুরা, নৌকায় ভাসমান চাষাবাদের দৃশ্য—এসবই সাহিত্যের অকুস্থল।

বাংলা ভাষার ইতিহাস, তার শব্দভান্ডার ও ব্যঞ্জনা—এসবই সাহিত্যের সৌন্দর্যর চাবিকাঠি। বাংলা ভাষা যে শুধু কথার মাধ্যম তা নয়; সেটি অভিব্যক্তির গভীর ভাণ্ডার। ভাষার লয়, উপমা, রূপক, আভিধানিক শব্দ—এসবই সাহিত্যে ব্যবহার করে লেখক এক বিশেষ ধাঁচ তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যিক রচনা হোক বা জসীম উদ্দীনের গ্রামীণ গান—প্রতিটি ভাষা ব্যবহারই এমন এক অভিজ্ঞতা দেয় যা পাঠককে ভেতরে টেনে দেয়। ভাষার রেশই সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ—কারণ ভাষায় লুকিয়ে আছে মানুষের কর্মপদ্ধতি, আচরণ, উৎসব, অভ্যাস ও বিশ্বাসের চিহ্ন। বাংলা ভাষার গান, কবিতা, গল্প—এসবই সময়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষের মনের দ্যুতি বহন করে।

সংস্কৃতি এবং সাহিত্য একে অপরকে পরিপূরক করে। সংস্কৃতি যদি মানুষের আচরণ, রীতি ও মূল্যবোধের সমষ্টি হয়, তবে সাহিত্য ঠিক সেই আচরণ, রীতি ও মূল্যবোধকে ভাষা দিয়ে চিত্রিত করে, প্রশ্ন তোলে, সমালোচনা করে, কিংবা প্রশংসা করে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি যেখানে স্থানীয় উৎসব, পারিবারিক রীতি, আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও পোশাকের মধ্য দিয়ে গঠিত, সেখানে সাহিত্য এই উপাদানগুলোকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে—চরিত্রের মধ্য দিয়ে, ঘটনার বর্ণনায়, মনের ভেতরের ডাইরিতে। গ্রামের মেলাবাজার কিংবা শহরের রেস্তোরাঁ—উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মিলন ঘটে; কারণ মানুষ যেখানে আছে, সেখানে ভাষা ও গল্পও আছে।

বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতি সাহিত্যকে বহু দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। পান্তাভাতের সরলতা, ইলিশের রসালো কাহিনী, পিঠার মিঠো স্মৃতি—এসব কেবল খাদ্য নয়; এগুলো মানুষের স্মৃতি, উৎসব, ও জীবন ধারার প্রতীক। পান্তাভাত ও ইলিশ কেবল ভোজনগত কারণে নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও প্রতীক। গ্রামের বাংলার নববর্ষের পিকনিক হোক বা শহরের বাড়িতে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতিনীতি—খাবার সেখানে শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, একটি সামাজিক সংকেত হিসেবেও বিবেচিত। সাহিত্যে এই খাবারের উল্লেখ মানুষকে সময় ও স্থান দিয়ে চিহ্নিত করে। একজন লেখক যখন কোনও দৃশ্যে পান্তাভাতের গল্প বলেন, পাঠক সেই দৃশ্যের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে ফেলে—কারণ খাদ্য স্মৃতি ও অনুভূতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

পোশাক ও নৃতত্ত্বও সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ। জামদানীর সূক্ষ্ম বোনা, মসলিনের ঐতিহ্য, পাঞ্জাবির স্বাতন্ত্র্য—এসব কেবল পোশাক নয়; এগুলো মানুষের সামাজিক মর্যাদা, ব্যক্তিগত পরিচয়, এবং নান্দিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। সাহিত্যে পোশাক ব্যবহারের মাধ্যমে লেখক চরিত্রের সামাজিক অবস্থান, মানসিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গকে ইঙ্গিত করতে পারেন। যেমন একটি শাড়ি কোনো নারী চরিত্রের গৌরব কিংবা তার জীবনবোধকে প্রকাশ করে, আর একটি পাঞ্জাবি পুরুষ চরিত্রের ধর্মীয় বা সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে নির্দেশ করে। ফলে পোশাক কেবল ভৌত ছাপ নয়; এটি সাহিত্যিক রূপক হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি—বাউল গান, পুঁথি, পালাগান, যাত্রাপালা—এসবই সাহিত্যে একটি গভীর, প্রাঞ্জল ও মানবিক স্বাদের সংযোজন হয়। লালন শাহের দর্শন, বাউলদের মুক্তচেতনায় ভরা গান—এসব শুধু সংগীত নয়; এগুলো মানুষের আত্মার খোঁজ। বাউলগানে মানুষের ভেতরের জীবন, সত্যের সন্ধান, চোখে দেখা অন্য রূপ—এসবই মিলিত। সাহিত্যে এই লোকজ উপাদানগুলো প্রবেশ করলে রচনায় যে দিকগুলো আসে তা হলো সরলতা, গভীর দর্শন এবং মানবিক স্পর্শ। পুঁথিপাঠ ও যাত্রা নাটকীয়তাও সাহিত্যের বর্ণনাকে প্রসারিত করে—তারা গ্রামবাংলার ইতিহাস, কাহিনী ও নৈতিক জ্ঞানকে বহন করে।

বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক জীবনও সাহিত্যের অনুঘটক। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এমন ঘটনাবলি যা সাহিত্যে শুধু প্রেক্ষাপট নয়; এগুলো হয়ে ওঠে সৃষ্টির উৎস। ভাষারためে আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধের কষ্ট—এসবই রচনাকে এক বিশেষ তেজ দেয়। কাব্য, উপন্যাস, গল্প—এসবেই স্বাধীনতা ও সংগ্রামের ভাষেশন আছে। লেখা হয় দেশপ্রেম, বীরত্ব, ত্যাগ, মানুষের দুর্দশা ও কাহিনী—যা পরবর্তীকালে জাতীয় স্মৃতিকে গড়ে তোলে। সাহিত্যের মাধ্যমে ইতিহাস জীবন্ত থাকে; কারণ কেবল ঐতিহাসিক বিবরণ নয়, মানুষের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লেখায় স্থান পায়। ফলে নতুন পড়া-শোনার মানুষের মনেও সেই ইতিহাসের স্রোত প্রবাহিত হয়।

সমকালীন সামাজিক পরিবর্তন সাহিত্যে নতুন প্রশ্ন ও নতুন ভাবনা এনেছে। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি, শহুরে কায়দা—এসব বিষয় রচনায় ঢোকে। তরুণ প্রজন্মের জীবনযাপন, তাদের যোগাযোগের ধরন, সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভাবনা—এসব আজকের সাহিত্যের কাঁচামাল। অনলাইন ব্লগ, ই-বুক, স্বল্পকথ্য ভিডিও—এসব মাধ্যম সাহিত্যকে নতুন ভিজ্যুয়াল ও শ্রবণশক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করছে। তরুণ লেখকরা বহুমাত্রিক রূপে সাহিত্যে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করছেন। তবে এই আধুনিকতা পুরোনো ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করছে বলে নয়; বরং পুরোনো ও নতুনের সংমিশ্রণ একটি নবীন ধারার রূপ দিচ্ছে। যেমন গ্রাম-শহর সম্পর্কের দ্বন্দ, পারিবারিক বন্ধন গলে যাওয়া, একাকিত্বের নিরুদ্দেশ—এসব বিষয়ই আজকের লেখার কেন্দ্রবিন্দু।

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানবিক মূল্যবোধ প্রচারের এক শক্তিশালী মাধ্যম। সাহিত্য শিক্ষক, মনস্তত্ত্ববিদ, আর্থ-সামাজিক চিন্তাবিদ—সবাইকে মানবতাবাদী চিন্তা-ভাবনা দিতে সক্ষম। সাহিত্যের কাহিনী পাঠককে সহানুভূতি, সমবেদনা, নৈতিক প্রশ্ন তোলে; চরিত্রদের দুর্দশা ও জয়—এসবই মানুষের মনের ভিতর নরমতা ও শক্তি আনতে পারে। বাংলাদেশের সাহিত্যে তাই মানবতার বার্তা বারবার ফিরে আসে—কারণ এই দেশের মানুষের জীবন বহু চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রাম দ্বারা আচ্ছন্ন। দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক অন্যায়—এসব বিষয় সাহিত্যকে প্ররোচিত করে, আর সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন সম্ভব হয়।

শিক্ষা ও পাঠের প্রসারও সংস্কৃতিকে রূপ দেয়। গ্রামে বইয়ের অভাব থাকলেও মৌখিক সাহিত্য ফলে থাকে; শহরে বই-গ্রন্থভাণ্ডারের প্রসার পাঠচর্চাকে ত্বরান্বিত করে। শিক্ষা ও সাহিত্যের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ—কারণ পাঠকের সংখ্যা বেড়ে গেলে লেখকরা নতুন বিষয় নিয়ে লিখতে উৎসাহিত হন। একই সঙ্গে সাহিত্য স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক সচেতনতা তৈরি হয়। ফলে ভাষা, ঐতিহ্য, ইতিহাস—এসব বিষয়ে সম্মানের ধারণা গড়ে ওঠে।

সংস্কৃতির সঞ্চার দেশের বাইরেও ঘটছে। প্রবাসী বাঙালিরা তাদের নতুন বাসভূমিতে পুরোনো ধারাকেই সঙ্গে নিয়ে যায়—সংস্কৃতি আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। প্রবাসে বাংলা ভাষার চার্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও লোকসংগীতের পরিবেশন—এসবই বাঙালি সংস্কৃতিকে দূরে থেকেও টিকে থাকতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা সাহিত্য অনুবাদ হওয়ায় বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে আমাদের গল্প, কবিতা ও উপন্যাস পৌঁছেছে। এতে একটি গর্বেরও সৃষ্টি হয়েছে—কারণ বাংলা সাহিত্যের ভাব ও ভাবনার অনুবাদ মাধ্যমে অন্য ভাষাভাষীরাও তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে।

সংস্কৃতি ও সাহিত্য কখনো স্থির নয়—এগুলো নদীর জলের মতো প্রবহমান, যে নিজের পথ নিজেই তৈরি করে এবং চলমান সমাজকে এগিয়ে যেতে শেখায়। তাই বলা হয়, সংস্কৃতি ও সাহিত্য কেবল অতীতের স্মৃতি নয়; এগুলো ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকেও বহন করে। সমাজে যুগে যুগে যে পরিবর্তন আসে, তার প্রতিটি ঢেউ-এ সাহিত্যের প্রতিফলন থাকে। নতুন লেখালেখি, নতুন ধাঁচের গল্প, সমকালীন কবিতা কিংবা উদ্ভাবনী নাটক—এসবই প্রমাণ করে যে সংস্কৃতি কোনো জড় ধারণা নয়; এটি ক্রমাগত নবায়ন ও পরিশীলনের মধ্য দিয়ে পথ চলে।

বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির যাত্রা এই নবায়নের চমৎকার উদাহরণ। পুরোনো দিনের পালাগান, বাউলগীতি, যাত্রাপালা কিংবা গ্রাম্য নাটকের ধারাকে ধরে রেখে আজকের আধুনিক মঞ্চনাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, মুক্তচিন্তার প্রবন্ধ—সবকিছুই এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারাবাহিক বিস্তার। এই ধারাকে বহন করে চলেছে নানান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য সংগঠন ও শিক্ষামাধ্যম। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পকলা একাডেমি, বিভিন্ন সাহিত্যচক্র, পাঠাগার, স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক ক্লাব—এসব জায়গা তরুণ প্রতিভাদের বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। তারা নতুন গল্প লিখছে, নতুন ছন্দে কবিতা রচনা করছে, নতুন নাট্যভাষা আবিষ্কার করছে। ফলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত আরও দৃঢ় হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে নতুন চিন্তার বিস্তার।

বিশেষ করে উৎসবমুখর পরিবেশ বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রাণ। জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন, স্থানীয় সাহিত্য উৎসব, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বইমেলা, নাট্যোৎসব, সংগীতানুষ্ঠান—সব মিলিয়ে এক বিস্ময়কর সমন্বয়। এসব উৎসব শুধু বিনোদন নয়; এগুলো মানুষের মনের ভেতরে সাহিত্যের প্রতি টান সৃষ্টি করে এবং নতুন লেখকদের সমাজে দৃশ্যমান করে। বইমেলায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা মেলে ছোট-বড় প্রকাশনীর হাজারো নতুন বই; পাঠকদের সামনে উঠে আসে নতুন লেখনী, নতুন চিন্তা, নতুন ভাষা। বইমেলার ধবল ছড়া, রঙিন স্টলের বিন্যাস, লেখককে ঘিরে পাঠকদের উৎসাহ, স্বাক্ষর নেওয়ার আনন্দ—এসব মুহূর্ত সাহিত্যকে কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখে না; বরং তা মানুষের অভ্যাস, অনুভূতি ও জীবনের ভেতরে প্রবেশ করায়।

লেখক-আড্ডার উষ্ণতা সাহিত্যচর্চার আরেক অনন্য উপাদান। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় আলোচনা হয় সমাজ, রাজনীতি, প্রেম, মানবতা, ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে। তরুণরা শেখে সিনিয়রদের কাছ থেকে, আর প্রবীণরা উপলব্ধি করেন নতুন প্রজন্মের ভিন্ন চিন্তার ভুবন। এই আন্তঃপ্রজন্ম সংলাপই একটি পরিণত সংস্কৃতির লক্ষণ। কারণ সংস্কৃতি কখনো একক প্রজন্মের নয়; এটি সকলের সম্মিলিত অভিজ্ঞতার ফল।

তাই সংস্কৃতি ও সাহিত্য কেবল অতীতের স্মারক বা ঐতিহ্য নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রেরণাও বটে। নতুন শিল্পচর্চা, নতুন রচনা, নতুন দর্শন—এসবই সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখে এবং সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের আজকের প্রজন্ম সাহিত্যকে যেভাবে ভালোবাসে, বইমেলায় ছুটে যায়, নাট্যমঞ্চে বসে থাকে, সংগীতাস্বাদন করে—তা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আরও সৃজনশীল, মানবিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করে তুলবে।

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম গভীর বৈশিষ্ট্য হলো তার সহনশীলতা ও বহুস্বরতা। এখানে বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম, জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটেছে; এই বহুমাত্রিকতা সাহিত্যে একটি বৈচিত্র্য এনে দেয়। সংস্কৃতির এই বৈচিত্র্যই সাহিত্যের উপকরণ বাড়ায়—বর্ণের ভিন্নতা, বিশ্বাসের ভিন্নতা, জীবনচিত্রের ভিন্নতা—এসব মিলেই সাহিত্যকে এক সম্ভাব্যতা দেয়। একজন লেখক যে কোনও প্রান্তের গল্প ধরতে পারে—কেননা বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে গল্প আছে, গান আছে, জীবনধারা আছে।

অবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি একে অপরকে সমৃদ্ধ করে, জাতীয় আত্মচেতনার নিদর্শন হিসেবে কাজ করে এবং মানুষের নৈতিক ও সামাজিক মানসিকতাকে আকার দেয়। নদী, মাটি ও মানুষের শব্দলোকে তৈরী এই ছন্দটি শুধু অতীতের কাহিনী নয়; এটি ভবিষ্যতের জন্যও এক নির্দেশ, এক আহ্বান। এই আহ্বান হলো—নিজেকে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে মানবিকতা, সৌন্দর্য, ও সংস্কারের প্রতি নিষ্ঠাবান করে তোলা। কারণ একটি জাতি যে ভাষা, গল্প, গান ও আচার ধারণ করে, তা তার অস্তিত্বকে প্রজ্বলিত রাখে।

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি তাই এক অসংখ্য রঙের চিত্রশালা—যেখানে প্রত্যেক রঙই আলাদা অথচ একে অপরের সঙ্গে মিশে একটি মঞ্জনীয় ছবি তৈরি করে। নদীর স্রোত যেমন কখনো মৃদু, কখনো তীব্র—তেমনি সাহিত্যের মর্মও কখনো কোমল, কখনো তEquথা তীব্র। মাটি যেমন পুষ্টি দেয়, তেমনি সংস্কৃতি মানুষকে পুষ্ট করে; আর মানুষ সেই শক্তিই রেখে দেশের সাহিত্যকে প্রসারিত করে। এই প্রবাহ চলতেই থাকবে—নদী, মাটি ও মানুষের শব্দলোকে—বাংলাদেশের কাব্যিক জীবন চিরন্তনভাবে বয়ে যাবে।

 

লেখকঃ শিক্ষক, লেখক ও শিক্ষক প্রশিক্ষক

 


আপনার মতামত লিখুন :
More News Of This Category

অভিনন্দন! দ্যা রয়েল কমনওয়েলথ রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্জন করার জন্য