• শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন
  • [gtranslate]
Headline
ধূমপানমুক্ত সমাজ গঠনে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ: গোলশূন্য খেলায় দু’দলই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ-২০২৬ দেশী ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ আপডেট: বিশ্লেষণ ও নির্দেশিকা (২০২৫-২৬) আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির অপরিহার্যতা: একটি বিশ্লেষণ রংপুরে ৫৬ দিনব্যাপী শিক্ষকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু ২০ ডিসেম্বর: বাংলা ও গণিত শিক্ষকদের অগ্রাধিকার হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন বিশ্লেষণ প্রাচীন সমতটের জনপদ থেকে আধুনিক কুমিল্লা: একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ নীল সীমার শেষ আলো এই দুনিয়ায় আমি এসেছি একা রংপুরে ICT4E জেলা অ্যাম্বাসেডর ও শিক্ষকদের মিলনমেলা: অতি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা বাস্তবায়নে  প্রযুক্তির ব্যবহারে গুরুত্বারোপ।
Notice
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে একদুয়ারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মনোহরদী, নরসিংদী তে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি চলছে।           ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুরে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি চলছে।

নীল সীমার শেষ আলো

Reporter Name / ৪৫ Time View
Update : বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

মোহাম্মদ শাহজামান শুভ।

ডিসেম্বরের হালকা শীতের ভোরে আমরা পাঁচজন—আমি, নাজমুল ইসলাম স্যার, আবু কালাম স্যার, মাসুদ স্যার এবং তোফায়েল মামা—দীর্ঘ পরিকল্পনার পর অবশেষে যাত্রা শুরু করলাম সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে। সমুদ্রের নীল বিস্তারের প্রতি আমাদের টান বহুদিনের, কিন্তু এই সফরের উত্তেজনা ছিল অন্যরকম। সবার চোখেমুখে একইরকম উচ্ছ্বাস—যেন বহুদিনের অপেক্ষার পর প্রিয় কোনও স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার সময় এসে গেছে। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ, আর সেখান থেকে সমুদ্রযাত্রা—সব মিলিয়ে পথটা যেন এক ধরনের ধীর কবিতার মতো, যা ধীরে ধীরে আমাদের নিয়ে গেল দেশের দক্ষিণের শেষ প্রান্তে, প্রবাল-ঘেরা স্বর্গদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে।

সেন্ট মার্টিনে পৌঁছেই মনে হলো আমরা যেন আরেকটি ভুবনে এসে দাঁড়িয়েছি। বাতাসে লোনা গন্ধ, ঢেউয়ের শ্বাস, আর দূরের নীলচে কুয়াশায় ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা নারকেলগাছ—সব মিলিয়ে পরিবেশটি যেন আমাদের ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিল। সৈকতে পা রাখতেই ঠান্ডা বাতাস এক ঝটকায় মনকে সরল করে দিল। দিনের আলোয় প্রবালের ঝলক, আর জোয়ার-ভাটার ছন্দে যেন দ্বীপটি নিজের গল্প বলছিল। কিন্তু এই দ্বীপও যেন আমাদের কাছে আরেকটি আগ্রহের দরজা খুলে রাখছিল—ছেড়া দ্বীপের আহ্বান।

পরদিন সকালে ভাটার সময় আমরা রওনা দিলাম ছেঁড়া দ্বীপের পথে। সেন্ট মার্টিন থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই দ্বীপকে স্থানীয়রা বলেন ‘ছেঁড়াদিয়া’। নামের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে তার পরিচয়—বিচ্ছিন্ন, আলাদা, স্বাধীন। হাঁটতে হাঁটতে যখন সামনে ছেঁড়া দ্বীপের ছায়া দেখা গেল, তখন মনে হলো আমরা যেন নীলিমার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি কোনও মায়াবী ভূমির দিকে।

ছেঁড়া দ্বীপে পৌঁছে প্রথমেই আমাদের চোখ আটকে গেল কেয়াবনের সুশৃঙ্খল সবুজে। লবণাক্ত বাতাসে দুলছে পাতাগুলো, যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। চারদিকে প্রবালের গা ছুঁয়ে আসা পানির ঝিলমিল, আর পাথরের ওপর দিয়ে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে দ্বীপটি যেন প্রকৃতির হাতে গড়া কোনও নিখুঁত শিল্পকর্ম। আমরা ধীরে ধীরে পাথরের ওপর হাঁটছিলাম, কখনো থামছিলাম ছবি তুলতে, কখনো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম নীল গভীরতায়।

এই দ্বীপের বিশেষত্বই হলো, জোয়ারে এর অর্ধেক অংশই পানির নিচে ডুবে যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে জলরাশির ভেতর কোনও নিঃসঙ্গ দ্বীপ তার নিঃশ্বাস আঁটে। সরকারের ঘোষিত ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে এখানে কোনও স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ—এ যেন প্রকৃতির নিজের স্থান, নিজের স্বাধীনতা। মানুষের স্পর্শ কম বলেই হয়তো ছেঁড়া দ্বীপ তার আসল রূপ ধরে রাখতে পেরেছে। আমাদের পায়ের নিচের প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ঢেউ যেন বলছিল—প্রকৃতির এই অংশটুকু এখনো অক্ষত।

দ্বীপের উত্তর দিকে ছিল ঝিনুকের সরু এক তটরেখা, যেখানে সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছিল শামুক-ঝিনুকের গোলাপি-সাদা খোল। দূরে পানির নিচে হালকা আলোয় দেখা যাচ্ছিল ছোট ছোট রঙিন মাছ—যেন তারা আমাদের দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। আমরা হাঁটছিলাম, আর ছেঁড়া দ্বীপ ধীরে ধীরে আমাদের হৃদয়ে নিজের চিহ্ন এঁকে দিচ্ছিল। নারকেল গাছের সারি যখন ঢেউয়ের ছন্দে নড়ছিল, তখন মনে হয়েছিল এই দ্বীপ আসলে মানুষের জন্য নয়—প্রকৃতি নিজের জন্য বানিয়ে নিয়েছে এক শান্ত, নির্জন, অপরূপ কোণ।

দুপুরের আলো যখন কিছুটা নরম হয়ে এল, তখন সমুদ্রের রঙ আরও বেশি মায়াবী হয়ে উঠল। নীলের ভেতরে সোনালি আভা, ঢেউয়ের ওপর হালকা রংধনু-ধরনের প্রতিচ্ছবি—এসব দৃশ্য চোখে দেখে মনে হচ্ছিল আমরা কোনও জলরঙের ছবির ভেতরে হাঁটছি। বাতাসে তখন এক ধরনের মুগ্ধতা, এক ধরনের স্বপ্নস্পর্শ ছিল। তোফায়েল মামা বললেন, “এমন জায়গা মানুষ ভুলতে পারে না।” তাঁর কথার সঙ্গে স্যারদের সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। সত্যিই, ছেঁড়া দ্বীপ ভুলে যাওয়া অসম্ভব।

আমরা যতটা সময় কাটালাম, ততটাই মনে হলো—সময় যেন থেমে গেছে। ঢেউয়ের শব্দে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা এসে পড়ল। আমরা ধীরে ধীরে সেন্ট মার্টিনে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু মন এক অদ্ভুত টানে আবদ্ধ হয়ে ছিল। যেন দ্বীপটি বলছিল—আরো একটু থাকো। পেছনে তাকালে কেয়াবন আর পাথরের স্তূপগুলো সোনালি রোদে ঝিলমিল করছিল। সেই দৃশ্য এমন ছিল যে, আমরা কেউই চাইলেও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না।

সেন্ট মার্টিনে ফেরার পথে আমাদের মনে হচ্ছিল, কিছু যেন রেখে এলাম পিছনে। হয়তো কিছু স্মৃতি, হয়তো কিছু স্বপ্ন, হয়তো কোনও অদেখা রং। ঢেউয়ের টানে টানে মনে হলো—ছেড়া দ্বীপকে আসলে ছাড়া যায় না; তাকে শুধু সাময়িক বিদায় জানানো যায়।

রাতের সেন্ট মার্টিন আরও রহস্যময়। ঢেউয়ের শব্দ যেন দূর থেকে আসা কোনও প্রাচীন প্রতিধ্বনি। সমুদ্রের বুক থেকে বাতাস এসে মুখে লাগে, আর তখন মনে হয় এই ভুবন—এই মানুষহীনতার সৌন্দর্য—আমাদের ভেতরের ক্লান্তি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। স্যাররা সবাই গল্প করছিলেন দিনভর অভিজ্ঞতা নিয়ে। নাজমুল স্যার বললেন, “আজকের দিনটা আমার জীবনের সেরা দিনের তালিকায় থাকবে।” আমরা হাসলাম, কিন্তু অন্তরে সকলের অনুভূতিই একই ছিল।

পাঁচ দিনের সফরটি যেন আমাদের জীবনে এক অনন্য ছায়া রেখে গেল। ছেঁড়া দ্বীপের নীল, কেয়াবনের সবুজ, পাথরের ওপর ঢেউয়ের আঘাত, আর সন্ধ্যার সোনালি ঝিলিক—সব মিলিয়ে এই সফর হয়ে উঠল এক নিখাদ সৌন্দর্যের যাত্রা। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া মানেই নিজের ভেতর ফিরে যাওয়া—এ সত্য আমরা আবারও উপলব্ধি করলাম।

সেন্ট মার্টিন ছাড়ার সময় আমাদের সবাইকে একই অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল—যেন হৃদয়ের ভেতর একটু ব্যথা জমে উঠেছে। আমরা ফিরে এলেও মনে হচ্ছিল, আমাদের এক অংশ এখনো পড়ে আছে সমুদ্রের নীল গহীনে।

এ সফরের স্মৃতি থাকবে দীর্ঘদিন। হয়তো সারা জীবন।

এ ভ্রমণ আমাদের শিখিয়েছে—মানুষ প্রকৃতির সন্তান, আর প্রকৃতির সৌন্দর্যে ডুবে যাওয়ার মধ্যেই জীবনের সত্যিকারের শান্তি লুকিয়ে আছে।

লেখকঃ শিক্ষক ও লেখক।


আপনার মতামত লিখুন :
More News Of This Category

অভিনন্দন! দ্যা রয়েল কমনওয়েলথ রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্জন করার জন্য