• শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন
  • [gtranslate]
Headline
ধূমপানমুক্ত সমাজ গঠনে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ: গোলশূন্য খেলায় দু’দলই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ-২০২৬ দেশী ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ আপডেট: বিশ্লেষণ ও নির্দেশিকা (২০২৫-২৬) আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রযুক্তির অপরিহার্যতা: একটি বিশ্লেষণ রংপুরে ৫৬ দিনব্যাপী শিক্ষকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু ২০ ডিসেম্বর: বাংলা ও গণিত শিক্ষকদের অগ্রাধিকার হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিবর্তন বিশ্লেষণ প্রাচীন সমতটের জনপদ থেকে আধুনিক কুমিল্লা: একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ নীল সীমার শেষ আলো এই দুনিয়ায় আমি এসেছি একা রংপুরে ICT4E জেলা অ্যাম্বাসেডর ও শিক্ষকদের মিলনমেলা: অতি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা বাস্তবায়নে  প্রযুক্তির ব্যবহারে গুরুত্বারোপ।
Notice
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে একদুয়ারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মনোহরদী, নরসিংদী তে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি চলছে।           ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুরে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি চলছে।

 জমিদারবাড়ির নিসর্গে একদিন

Reporter Name / ৮৯ Time View
Update : সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫

মোহাম্মদ শাহজামান শুভ

তিতাস উপজেলায় পর্যটনের মতো বড় আকর্ষণ নেই—এ কথাটি আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। কিন্তু সত্যিই কি তাই? স্কুল ছুটির নরম দুপুরে ছেলে–মেয়ে সাবা ও জামিকে নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বের হলাম, ভাবনার ভেতর এমনই প্রশ্ন ঘুরছিল। আমাদের পাশের গ্রাম—মজিদপুর। কতবার যে গেছি, কতবার যে হেঁটেছি—গুনে বলা যাবে না। অথচ আমার নিজের সন্তানরা এই গ্রামের জমিদার বাড়ির ইতিহাস জানে না, পুরোনো দালানকোঠার সৌন্দর্য চোখ ভরে দেখেনি। মনে হলো, আজ না হলে আর কবে? তাই পরিচিত পথ ধরে অচেনা আবিষ্কারের এক যাত্রা শুরু হলো আমাদের।

মজিদপুর জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণে পা রাখতেই যেন সময় থেমে দাঁড়াল। ভগ্নদশা ইটের দেয়ালের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছিল বহু পুরোনো দিনের সুর। একসময় এই প্রাসাদগৃহগুলো ছিল শক্তি ও প্রভাবের প্রতীক, ছিল জমিদারী শাসনের কঠোর ছায়া। আর আজ—নিঃশব্দ, স্থির, অথচ ইতিহাসের গন্ধে মোড়া। সাবা অবাক চোখে ভগ্ন অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, এত বড় বাড়ি! এখানে কি খুব ধনী লোক ছিল?” তার সেই মুগ্ধতা আমাকে যেন আরও গভীরে নিয়ে গেল অতীতের স্মৃতির দিকে।

ইংরেজ শাসনামলের শুরুর দিকে লর্ড কর্ণওয়ালিস যখন জায়গীরদারী প্রথা বিলুপ্ত করে জমিদারী চালু করেন, ইতিহাসের স্রোত তখন নতুন দিকে মোড় নেয়। মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের বিদ্বেষ, সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কারণে জমিদারীর দায়িত্ব পায় হিন্দু তাবেদার ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর লোকজন। বৃহত্তর দাউদকান্দি তখন ছিল মূলত মুসলমান অধ্যুষিত; কোনো প্রভাবশালী জমিদার ছিল না। কিন্তু সোনারগাঁয়ের হিন্দু জমিদাররা সেই পুরো পরগণার নিয়ন্ত্রণ নিতেন। তিতাসের মজিদপুরেও তাদের স্মৃতি আজও জীবন্ত।

জমিদার বাড়ির ভেতর হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো ভঙ্গুর অট্টালিকার সারি—কখনো ছিল ১৭টি, এখন তিনটি নেই, বাকিগুলোও সময়ের ভারে কাঁপছে। তবু ভগ্ন হলেও কারুকার্যে ভরা এই স্থাপনাগুলো যেন বারবার জানিয়ে দিচ্ছে তাদের অতীত গৌরবের কথা। লতাপাতায় ঢাকা জানালার ফ্রেম, ধসে পড়া বারান্দা, ছাদের ভাঙা কারুকাজ—সবই যেন কোনো বিস্মৃত শিল্পীর অসমাপ্ত মহাকাব্য।

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিশাল দীঘি আর ছোট-বড় পুকুরগুলো প্রাচীন জীবনের ছাপ বহন করে। জলের ওপর ভাসছে বাতাসে দুলে ওঠা গাছের ছায়া, তীরের ধারে বড় বড় তাল-লিচু গাছ নীরবে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু ঘটনার। সাবা আর জামি দিগন্তজোড়া জল দেখে মুগ্ধ—তাদের চোখে ভেসে ওঠে ‘ভ্রমণ’। অথচ আমার মনে জেগে ওঠে ইতিহাসের ভার। এখানকার মানুষ কত গল্প শুনিয়েছে! কত অত্যাচার, কত কান্না—সব এই জল, গাছ, দেয়াল জানে।

জমিদার বাড়ির প্রথম পুরুষ শ্রী রামলোচন রায় নাকি এখানেই এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মেঘনা, হোমনা, তিতাস, মুরাদনগর—সবই ছিল তাদের জমিদারীর সীমানা। তার তিন পুত্র—কালীচরণ রায়, ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এবং শিবচরণ রায়—বংশ পরম্পরায় চালিয়ে গেছেন শাসন। কালীচরণের পাঁচ ছেলে, ব্রজেন্দ্রর তিন ছেলে, শিবচরণের দুই ছেলে—সবাই মিলে ছোট এক রাজ্য পরিচালনা করতেন। কারও ছিল শিক্ষা, কারও ছিল চিকিৎসা জ্ঞান, কারও ছিল নেতৃত্বের খ্যাতি। আবার অনেকে ছিলেন নিষ্ঠুরতার প্রতীক। ক্ষিতিষ চন্দ্র রায়ের গল্পটি তো আজও স্থানীয়রা থমকে গিয়ে বলেন—গর্ভবতী স্ত্রীকে হত্যা করে উন্মাদ হয়ে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে শেকলবন্দী হয়ে মারা যান তিনি। একসময় জমিদারদের এমন অদ্ভুত, কখনো নির্মম, কখনো তেজস্বী ব্যক্তিত্বই পরিচালিত করতো পুরো সমাজব্যবস্থা।

হাঁটতে হাঁটতে সাবাকে একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি জানো, এই জমিদাররা কিভাবে মানুষের উপর শাসন করতো?” সাবা বলল, “যা খুশি তাই করতো?” আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। খাজনা দিতে না পারলে জমি কেঁড়ে নিত, সুদের টাকায় মানুষকে দাস বানিয়ে রাখত, এমনকি মুসলমানরা তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে হাঁটতেও পারত না।” সাবা বিস্মিত। সে যে সময়ের সন্তান—যেখানে স্কুলে সবাই সমান, দেশে সবাই স্বাধীন। অথচ তার সামনে দাঁড়ানো ভগ্ন দালানগুলি একসময় অসমতার প্রতীক ছিল।

জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কিছু তেজস্বী মানুষও। সময় বদলে দেয় সবকিছু—হাবিবুর রহমান মাস্টারের মতো সাহসী ব্যক্তিত্ব প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় মুসলমানরা জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে শুরু করে। এরপরই জমিদাররা এলাকা ছেড়ে ভারতে চলে যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়। ইতিহাসের চাকা আবার ঘুরে যায়।

জমিদার বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি খোপ, প্রতিটি সুড়ঙ্গ যেন গভীর নীরবতায় অতীতকে ধরে রেখেছে। শিশুরা যখন খোলা মাঠে দৌড়াচ্ছিল, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রাচীন এক দালানের ভাঙা সিঁড়িতে। আমার ছোটবেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় ঠিক এ পথেই। সাবা ও জামিকে সেই স্কুল দেখাতে গিয়ে মনে হলো—সময়ের কত পরিবর্তন! শৈশবের সেই স্কুল, সেই মাঠ—সবই এখনো আছে, কিন্তু আমরাই বদলে গেছি, বদলে গেছে দৃষ্টিভঙ্গি।

জমিদার বাড়ির চারপাশের প্রকৃতি যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার কবিতা। পুরোনো অট্টালিকা আর বিশাল দীঘির জলে পড়ে থাকা নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবি—সব মিলিয়ে তিতাসের এই কোণটিকে করে তুলেছে অপূর্ব। অথচ আমরা কত কম দেখি! কত কম জানি!

সব মিলিয়ে মনে হলো, তিতাস উপজেলায় পর্যটনের জন্য আলাদা কোনো জায়গা না থাকলেও—মজিদপুর জমিদার বাড়িই তো এক মহামূল্যবান ঐতিহ্য! ইতিহাস, স্থাপত্য, প্রকৃতি—সব মিলিয়ে এটি আশেপাশের অনেক উপজেলার চেয়েও অনন্য।

ফেরার পথে আকাশে পড়ছিল নরম বিকেলের আলো। সাবা বলল, “বাবা, এত সুন্দর জায়গা আমরা আগে দেখিনি কেন?” আমি মৃদু হাসলাম। সত্যিই, কখনো কখনো পরিচিতের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বিস্ময়। আমরা শুধু দেখে উঠতে পারি না।

মজিদপুর জমিদারবাড়িকে নতুন চোখে দেখার এই যাত্রা তাই শুধু ভ্রমণ নয়—এ ছিল অতীতকে চিনে বর্তমানকে বোঝার এক নিঃশব্দ পাঠশালা।

লেখকঃ শিক্ষক ও লেখক


আপনার মতামত লিখুন :
More News Of This Category

অভিনন্দন! দ্যা রয়েল কমনওয়েলথ রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্জন করার জন্য